Wednesday, November 13, 2013

পাঁচ মহারথী

১৪ নভেম্বর তারিখটা ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা যে অনেক দিন মনে রাখবেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেদিন শচীন তেন্ডুলকার তাঁর ২০০তম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামবেন। এর আগে কেউই ২০০ টেস্টের মাইলস্টোন ছুঁতে পারেননি সুতরাং সেদিক দিয়ে দেখলে এটা একটা বিশাল কৃতিত্ব কিন্তু তার থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল যে শচীন তাঁর ২৪ বছরেরও বেশী দীর্ঘ ক্রিকেট জীবন শেষ করবেন ঐ ম্যাচটি খেলে।
মিডিয়ার সৌজন্যে এটা আজ সবাই জানে। লাখ লাখ শব্দ এর মধ্যেই খরচ হয়ে গেছে এই ঘটনার পেছনে। শচীন কি ছিলেন, শেষ কদিন তিনি কি করছেন, কি ভাবছেন, তাঁর পরিবারের লোকজন কি করছে, তাঁর বন্ধুরা কি করছে সেটা জানতে আর বাকি নেই কারো। আমি সে সব লিখে পাতা নষ্ট করতে চাই না। তার চেয়ে বরং আমার নিজের ঠিক কি মনে হচ্ছে সেটা লিখি।
শচীন একজন দারুণ খেলোয়াড়, প্রচুর রেকর্ড, অনেক অনেক রান আর উইকেট, বেশ কিছু ম্যাচ জেতানো ইনিংস, সব মিলিয়ে আমার জীবনে শচীনের কম স্মৃতি নেই। ১৯৯১ সাল থেকে খেলা দেখছি আর এতদিন শচীনই ছিল একমাত্র constant factor. কিন্তু তবু আমার কাছে শচীনের এই অবসর আমার কাছে শুধু শচীন নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের একটা পুরো যুগের অবসান। সেটার কথাই লিখি।

আজকে মহেন্দ্র সিং ধোনির এই দলটা গত ৪ বছর ধরে প্রচুর সাফল্য পেয়েছে, টেস্ট র‍্যাঙ্কিং-এ ১ নম্বর স্থান, বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, দেশের মাটিতে প্রচুর সাফল্য, বিরাট কোহলি, শিখর ধাওয়ানের মত কিছু অসাধারণ খেলোয়াড়ের প্রচুর ম্যাচ জেতানো ইনিংস, সব মিলিয়ে এই দলটাই ভারতীয় ক্রিকেটের ‘সোনালী প্রজন্ম’। কিন্তু এরাই কি আমাদের, মানে আমার মত যাঁরা গত ২৫ বছর যাবৎ ক্রিকেট দেখছেন তাঁদের প্রিয় দল?
আমার কাছে নয়, হ্যাঁ অস্বীকার করছি না এই দলটাও আমার খুব প্রিয় কিন্ত সবচেয়ে প্রিয় কি? সেই প্রশ্নের উত্তর না। কারণ আমার সবচেয়ে প্রিয় যে দল সেটাকে আমি বলি ভারতীয় ক্রিকেটের ‘রোমান্টিক প্রজন্ম’, হ্যাঁ এই দল হয়তো ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল নয়, অনেক অনেক অসাধারণ, মনে রাখার মত স্মৃতি সত্বেও হয়তো অনেক না পাওয়া আছে এই দলটার কাছ থেকে কিন্তু সাফল্য হয়তো সব সময় শেষ কথা নয়। অনেক অনেক মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার মত মুহূর্ত দিয়েছে এই দল। আর শুধু শচীন নয়, আমার কাছে আমার ‘রোমান্টিক প্রজন্মের’ নিউক্লিয়াস পাঁচ জন। অনিল কুম্বলে, শচীন তেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাভিদ এবং ভেঙ্কট সাই লক্ষণ।
এই পাঁচ জনের এক একটা পারফর্মেন্স, রান, সেঞ্চুরি, উইকেট আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। মনে হয়েছে, আরে এটা তো আমার সাফল্য, আমার আনন্দ। লক্ষণের রান আউট কিম্বা কুম্বলের একটা খারাপ স্পেল দেখে যেন দিনটা খারাপ গেছে আমারও। আবার ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে যখন দেখেছি শচীনের কভার ড্রাইভ বা রাহুলের স্কোয়ার কাট মনে হয়েছে দিনটা এত ভালো শুরু হল, খারাপ যাওয়া আর সম্ভব নয়।
আর ওদের নিয়েই এই লেখা, এই পাঁচজনকে নিয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় কিছু স্মৃতি।

আলোকোজ্জ্বল ইডেন গার্ডেন থেকে বলছি...
১৯৯৩ সালে সিএবির ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজন করা হয় হিরো কাপ, ভারত সহ আরো পাঁচটি দেশ নিয়ে। এই প্রথম ইডেন গার্ডেনের ফ্লাড লাইটের মায়াবী আলোয় খেলা হয় সেমি ফাইনাল আর ফাইনাল।
প্রথম সেমিফাইনালে যখন শেষ ওভারে যখন ৬ রান করলেই দক্ষিণ আফ্রিকার জয় নিশ্চিত, কপিল দেব বা জাভাগল শ্রীনাথের বদলে বল করতে এসে মাত্র ৩ রান দিয়ে ভারতকে জয় এনে দেয় শচীন।
ফাইনালে অবশ্য এতটা কষ্ট করতে হয়নি ভারতকে। অনিল কুম্বলের ১২/৬ (একদিনের ক্রিকেটে এখনো ভারতীয়দের মধ্যে সেরা বোলিং হিসেব) এর দৌলতে সহজেই ১০২ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে কাপ যেতে ভারত।

ভারতের নতুন ওপেনার
১৯৯৪ সালের ২৭শে মার্চ তারিখে ভারত আর নিউজিল্যান্ডের অতি সাধারণ একটা ক্রিকেট ম্যাচ আজও স্মরনীয় আছে শচীন তেন্ডুলকারের জন্য। প্রথমবার একদিনের ক্রিকেটে ওপেন করতে নেমে শচীন ৪৯ বলে ১৫টা চার আর ২টো ছয়ের সাহায্যে অবিশ্বাস্য ৮২ রান করে। সেই শুরু, শচীনের মোট ১৮,৪২৬ রানের মধ্যে ১৫,৩১০ রানই করা ওপেন করতে নেমে করা।

লর্ডসের সেই টেস্ট ম্যাচটা...
ভারত বিশ্বকাপ জিতেছিল ১৯৮৩র জুন মাসে। ১৯৯৬ সালের আর এক জুন মাস থেকে বদলে গেল ভারতীয় ক্রিকেটের গতি-প্রকৃতি যখন, আমার মতে ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান এবং সর্বকালের সেরা অধিনায়ক শুরু করল তাদের টেস্ট যাত্রা। সৌরভ প্রথম টেস্টেই শতরান করলেও রাহুল আটকে যায় ৯০-র ঘরে। তবে এইভাবে দুই বন্ধুর একসঙ্গে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের জাত চেনানো আমার সবচেয়ে প্রিয় দিনগুলোর মধ্যে একটা।


শচীনের গুপ্ত অস্ত্র
আমি যখন খেলা দেখা শুরু করি তখন পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা মানের ভারতের জেতার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। ছবিটা আস্তে আস্তে বদলেছে, এখন ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে ভারতের দিকেই পাল্লাটা ভারী থাকে। আর পরিবর্তনের প্রথম ধাপ ছিল ১৯৯৭ সালের সাহারা কাপ। টরেন্টোতে হওয়া ৫ ম্যাচের সিরিজে ভারত জেতে ৪-১। টানা ৪টে খেলায় ম্যান-অফ-দ্যা-ম্যাচ হওয়ার রেকর্ড করে সৌরভ। সে রেকর্ড এখনও অক্ষত। গোটা সিরিজে সৌরভ করে ২২২ রান, সঙ্গে ১৫টা উইকেট। শচীন প্রেস কনফারেন্সে বলে, “সৌরভ আমার দলের গুপ্ত অস্ত্র!”

শারজার মরুঝড়
আমার অত্যন্ত প্রিয় দুটো ইনিংস। পর পর দুদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের নিয়ে ছেলে খেলা করে শচীন। শুধু তাই নয়, দুটো ম্যাচেই একা লড়াই করেছিল শচীন। প্রথম দিন না জিতলেও ফাইনালে যাওয়ার রাস্তা খুলে গেছিল রানরেটের ভরসায়। ফাইনালে জয় আর তারপর শচীনের পাওয়া গাড়িতে চড়ে গোটা দলের মাঠ প্রদক্ষিণ এখনো চোখের সামনে ভাসে।

চেন্নাই, ১৯৯৯
পাকিস্তানের কাছে হারলে খারাপ লাগাই স্বাভাবিক, তার ওপর সেটা যদি আবার জেতার মত জায়গা থেকে হঠাৎ করে মাত্র ১২ রানে হার হয়। তার সঙ্গে পিঠে যন্ত্রনা নিয়ে করা শচীনের অসাধারণ ১৩৬ রানের ইনিংস। একটা অদ্ভুত মন খারাপ করা রোমান্টিসিজম আছে এই ম্যাচটার।


দশ উইকেটের ম্যাজিক
ঐ সিরিজেরই দ্বিতীয় টেস্টে ইতিহাস তৈরী করে অনিল কুম্বলে। জিম লেকারের পর দ্বিতীয় বোলার হিসেবে টেস্টে এক ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড তাও আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, ২১ বছর পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচ যেতে ভারত। চেন্নাইয়ের হারের পর দারুণ আনন্দ দিয়েছিল এই ম্যাচটা।

সব ম্যাচের সেরা
২০০১ সালের ইডেন টেস্ট ম্যাচটা যে ভারতের ৮ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ম্যাচ তা নিয়ে খুব বেশী লোক হয়তো দ্বিমত হবেন না। একটানা ১৬টা টেস্ট জেতা স্টিভ ওয়ার অশ্বমেধের রথকে মাটিতে নামিয়ে দেয় সৌরভের দলের ছেলেরা। তাও আবার ফলো-অন করার পর। হরভজনের হ্যাট্রিক সহ তেরটা উইকেট, ম্যাচের চতুর্থ দিনে সারাদিন লক্ষণ-রাহুলের যুগলবন্দী, শেষদিন টি এর পর শচীনের তিন উইকেট আর দিনের শেষে ভারতের জয়। এই ম্যাচের তুলনা কোথায়! 


ভাঙ্গা চোয়াল তো কি, লড়াই চলবে...
অনিল কুম্বলে ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা ম্যাচ উইনার। উপমহাদেশের পিচে পনেরো বছর ধরে  ভারতকে একের পর এক টেস্ট জিতিয়েছে অনিল। কিন্তু ২০০২-র ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে চতুর্থ টেস্টে অ্যান্টিগাতে অনিল সাহসের যে নিদর্শন দেখিয়েছিল তা বিশ্ব ক্রিকেটে বিরল। মারভিন ডিলনের বাউন্সারে চোয়াল ভেঙ্গে যাওয়া অবস্থায় ব্যান্ডেজ বেঁধে মাঠে ফিরে এসে একটানা ১৪ ওভার বল করে ব্রায়ান লারার উইকেট। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে!

যুবশক্তির উত্থান
সৌরভ অধিনায়ক হওয়ার পর থেকেই ভারতীয় দলে অল্প-বয়স্ক খেলোয়াড়দের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ম্যাচ-ফিক্সিং বিতর্ক, খারাপ ফর্ম আর চোট-আঘাতের দৌলতে দলে আসে হরভজন সিং, জাহির খান, বীরেন্দ্র সেহবাগ, যুবরাজ সিং, মহম্মদ কাইফের মত তরুন-তুর্কির দল। তারা আস্তে আস্তে নিজেদের নিয়মিত করে তোলে ভারতীয় দলে।
ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালে ৩২৫ রান তাড়া করে সৌরভের দ্রুত ৬০ রানের ওপর ভর দিয়ে ভালোই শুরু করে ভারত। কিন্তু নিয়মিত উইকেট পড়তে পড়তে ১৪৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে যখন ভারতের করুণ দশা তখন হাল ধরে কুড়ি বছরের যুবরাজ আর একুশ বছরের কাইফ। অসাধারণ স্ট্রোক-প্লে আর দ্রুত সিঙ্গলসের ওপর ভর দিয়ে ভারতকে নিয়ে যায় জয়ের দোরগোড়ায়। আর শেষ ওভারে জেতার পর উত্তেজনায় লর্ডসের ব্যালকানিতেই সৌরভের নিজের জার্সি খুলে ওড়ানো, সে তো ভারতীয় ক্রিকেটের লোকগাথার অংশ হয়ে গেছে!


তিন মূর্তির শতরান
শচীন, রাহুল এবং সৌরভের মধ্যে যেকোন দুজনের যুগলবন্দীর অভাব নেই। খুঁজলে ওরকম অনেক অনেক ম্যাচই পাওয়া যাবে। কিন্তু ২০০২এর হেডিংলি টেস্টই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একমাত্র উদাহরণ যেখানে ঐ তিন জনেই সেঞ্চুরি করেছিল।
ম্যাচটাও আমার বেশ পছন্দের। নিজেদের শক্তিতে খেলার জন্য ভারত কুম্বলে আর হরভজন দুজনকেই দলে নেয়। সঙ্গে মাত্র দুজন মিডিয়াম পেসার। তাই টসে জিতেও হেডিংলির পেস-বোলিং সহায়ক পিচে ব্যাটিং নিতে বাধ্য হয়ে ভারত। প্রথম দিনে রাহুল আর সঞ্জয় বাঙ্গারের আসাধারণ ব্যাটিং-এর ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় দিন হাত খোলে শচীন-সৌরভ। ভারতের মোট রান দাঁড়ায় ৬০০ র বেশী। শেষ পর্যন্ত অনিলের ৭ উইকেটের ওপর ভর দিয়ে ইনিংসে ম্যাচ যেতে ভারত। স্পিনাররা নেয় মোট ১১ উইকেট।

বিশ্বকাপ মানেই পাকিস্তান বধ...
২০০৩ এর বিশ্বকাপ অনেক কারণেই স্মরনীয়। খুব সাধারণ শুরু, গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে বিশাল হার, খেলোয়াড়দের বাড়িতে ইঁট বর্ষণ, আর তারপরেই চমকপ্রদ ঘুরে দাঁড়ানো। ফাইনাল অবধি টানা ৮ ম্যাচে জয়। সবচেয়ে মনে রাখার মত ম্যাচ ছিল সেঞ্চুরিয়নে পাকিস্তানের সঙ্গে। পাকিস্তানের ২৭৩ রান তাড়া করতে নেমে আক্রমের প্রথম ওভারে ৯ রান করে ভারত। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভার মানে শোয়েবের প্রথম ওভারের শেষ তিন বলে শচীন ৬, ৪, ৪ মেরে ওভারে মোট ১৮ রান করে। শচীন শেষ অবধি ৯৮ রানে আউট হলেও যুবরাজকে সঙ্গে নিয়ে সহজেই রান তাড়া করে ফেলে রাহুল।
শচীনের ঐ ৯৮ একদিনের ক্রিকেটে আমার প্রিয় শচীন ইনিংস!

স্টিভের বিদায়বেলায়...
গত পঁচিশ বছরে আমার সবচেয়ে পছন্দের বিদেশ সফর। ৪ টেস্টের সিরিজে যে কতগুলো মনে রাখার মত মুহূর্ত ছিল গুনে শেষ করা যায় না। তবু বলতে হলে সৌরভের ব্রিসবেনের ১৪৪, অ্যাডিলেডে রাহুলের ডাবল সেঞ্চুরি, লক্ষণের শতরান, তারপর আগারকরের ৬ উইকেটের দৌলতে জেতার সুযোগ, চতুর্থ ইনিংসে রাহুলের অনবদ্য ইনিংস, সিডনি টেস্টে শচীনের অসামান্য ২৪১ আর লক্ষণের ১৭৮ আর বাকিদের সাহায্যে ভারতীয় দলের প্রথমবার টেস্ট ক্রিকেটে ৭০০ র বেশী রানের ইনিংস এগুলো বলতেই হয়। স্টিভের শেষ সিরিজে ১-১ ফলেই খুশী থাকতে হয় তাঁকে। তাঁর চোখের সামনে বর্ডার-গাভাসকার ট্রফি নিজের কাছে রেখে দেয় ভারত অধিনায়ক সৌরভ।

পাকিস্তানে প্রথম জয়
২০০৪ সালের আগে অবধি ভারতীয় ক্রিকেটে একটা অভিশাপ ছিল। কোন ভারতীয় অধিনায়ক পাকিস্তান সফরের পর নিজের অধিনায়কত্ব বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। এমনকি পাকিস্তানের মাটিতে একটাও টেস্ট জয় ছিল না ভারতের। কিন্তু সবই বদলে যায় ভারতের ২০০৪র পাকিস্তান সফরে।

১৪ বছর পর পাকিস্তান যায় ভারতীয় দল, তাদের সঙ্গে বিশেষ ক্রিকেট-ভিসায় পাকিস্তান যায় প্রচুর সংখ্যক ভারতীয় সমর্থক। উৎসাহের কোন কমতি ছিল না এই সিরিজ নিয়ে। এই সিরিজেও অনেক গুলো মনে রাখার মত ম্যাচ ছিল। করাচিতে রাহুলের ৯৯, কাইফের অসাধারণ ক্যাচ, রাওয়ালপিন্ডিতে শচীনের শতরান সত্বেও ভারতের হার, শোয়েবের বলে বালাজীর ছক্কা, শেষ ম্যাচে শচীনের অসাধারণ ক্যাচ! ভারত একদিনের সিরিজ জেতে ৩-২। টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচেই সেহবাগের ৩০৯, সঙ্গে শচীনের ১৯৪। পাকিস্তানে প্রথম টেস্ট জেতে ভারত। আর শেষ টেস্টে আমার রাহুলের ২৭০-এর ওপর ভর দিয়ে ২-১ সিরিজ জেতে ভারত। পাকিস্তানে সেই প্রথম।

মহারাজের রাজধানীতে
১৯৯৩-এর ইডেন গার্ডেন দিয়ে শুরু করেছিলাম, ২০০৭-এর ইডেন গার্ডেন দিয়ে শেষ করি। বিপক্ষ ছিল পাকিস্তান, আর ঘরের মাঠে নিজের একমাত্র টেস্ট শতরান করে সৌরভ। আমি ভাগ্যবান, সেদিনের সত্তর হাজার ইডেনমুখো জনতার মধ্যে আমিও ছিলাম। নিজের চোখে দেখেছিলাম, সৌরভের শতরান আর তার পরের উচ্ছাস! সঙ্গে লক্ষণের কাব্যিক শতরান। সেটা তো একটা বাড়তি পাওনা!

ভারতীয় ক্রিকেটে এই পাঁচ জনের অবদান শুকনো পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যায় না। ভারতীয় ক্রিকেটের বিবর্তণ আর আধুনিকীকরণের প্রধান স্থপতি এই পাঁচ জন। আমি ভাগ্যবান যে আমার ক্রিকেট মুগ্ধতা এসেছে এই পাঁচ মহারথীর হাত ধরে। ধন্যবাদ শচীন, আমার ছোটবেলাকে এত স্মরনীয় করে রাখার জন্য। কিন্তু শুধু শচীন নয়, অনেকটা ধন্যবাদ তোলা থাক অনিল, রাহুল, লক্ষণ আর সৌরভের জন্যেও।

[এই লেখার সমস্ত ছবি Cricinfo ও অন্যান্য ক্রিকেট সংক্রান্ত ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।]

Tuesday, November 5, 2013

Happy Birthday Virat

I first noticed him in 2008.He was leading the Indian U-19 team in the World cup. I saw a few matches, observed that he was a very active and tactful captain in field (much like SG) and also shuddered at the expletives came out of his mouth after winning the World cup beating SAF.
Few days later I visited his Orkut profile and saw an 'about me' full of sms English as well as words like Fuck, screwed and all. The new generation... I thought.
I remember his debut series against Sri Lanka (who else) in a low scoring series in Dambula and started liking his batting more and more.
In last 5 years I have seen so many great innings by him in ODIs, IPL and even in Tests. His chasing success has already reached a legendary status. I remember his vicious attack on Malinga in Australia or the 183 against Pakistan as well as the twin centuries against the Aussies in the last series. I am following the astonishing rate at which he his reaching his ODI century land marks.
But for me the long lasting memory of Virat Kohli would always be the attached video. It showed how he has matured, not only as a cricketer as well as a human being.



Happy Birthday Virat. Proud of you. Hope there will be another player, who may be just 5-6 years old now, who will become an Indian cricketer some day and may be after winning the 2027 World cup he will lift you on his shoulder and say those golden words, “Well He has carried the burden of the nation for 21 years, so it’s time we carried him on our shoulders”, just like you did on 2nd Aprill 2011 Night.
Source: Internet

Monday, October 21, 2013

স্বঘোষিত সিনেমাবোদ্ধাদের নিয়ে দু-চার কথা

ফেসবুক অতি কাজের জিনিস! পুরনো বন্ধু-বান্ধব, রেলাবাজ পাড়ার দাদা, বিরক্তিকর কলেজের জুনিয়ার, অফিসের সুন্দরী সহকর্মিনী সবার সব খবর সময় মত পাওয়া যায়। কে কাকে বিয়ে করল, কার কবার ব্রেক-আপ হল, কে অফিসের ট্যুরে বিদেশ গেল, কে অফিস কেটে হিমাচলে গিয়ে গাঁজা খেল সব খবরই যাকে বলে আঙ্গুলের ডগায়! এছাড়া ফেসবুকে নানা বিষয় নিয়ে নিজেদের মতামত প্রদান করাও যায় বৈকি। সে আপনি খেলা বলুন, সাহিত্য বলুন কিম্বা দেশ-বিদেশের চলচিত্র। আর ফেসবুকের এইসব বাঙ্গালী সিনেমাবোদ্ধাদের চারিত্রিক বিশিষ্টের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যই এই লেখা।

১. Angry Young Man

এরা সকলেই সবসময়েই অত্যন্ত রেগে আছেন। যেকোন সিনেমা(নাকি ফিল্ম!) দেখে খারাপ লাগলে হতাশা বা দুঃখের কোন জায়গা নেই এদের কাছে। এদের শুধু হয় দাঁত কিড়মিড়ে  রাগ এবং তারপর ফেসবুকে এসে তাদের আখাম্বা লম্বা লম্বা পোস্ট দিয়ে তাদের সেই রাগেরই বহিঃপ্রকাশ।

২. অপছন্দেই আনন্দ

এদের প্রায় সকলেরই সিনেমা নিয়ে প্রচন্ড তীব্র পছন্দ-অপছন্দ আছে। বিশেষ করে এদের অপছন্দের নায়ক বা পরিচালকদের গালমন্দ করতে এরা কোনদিনই ক্লান্ত হয় না। কিন্তু তারপরেই... যে মুহূর্তে তাদের অপছন্দের নায়ক/নায়িকা বা পরিচালকদের সিনেমা বাজারে এল সঙ্গে সঙ্গে হলে গিয়ে, দরকার হলে ব্ল্যাকে টিকিট কেটে প্রথম সপ্তাহেই সেটা না দেখলে তাদের চলে না। আর তারপরেই গোটা ফেসবুক জুড়ে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ, আগেই যার কথা বলেছি।

৩. রেখেছ বাঙ্গালী করে...

এরা প্রধানত বিদেশী (আজকাল ইরানি, জাপানী এবং পূর্ব ইউরোপীয় সিনেমা আঁতেলদের মধ্যে চলছে ভাল!) সিনেমা দেখে। ভারতীয় সিনেমা যে এরা দেখে না তা নয় তবে সেগুলো শুধু সেই ভাষারই যেটা তারা জানে না। বাংলা বা হিন্দিতে তৈরী যেকোন সিনেমাই এদের কাছে ট্র্যাশ আর বাজার-চলতি বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমা তো এদের কাছে আলোচনারই যোগ্য নয়। যদিও সেই সিনেমাটি যে তামিল বা তেলেগু সিনেমা থেকে বানানো হয়েছে সেই নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পোস্ট করে যেতে এরা ক্লান্ত হয় না, লোকে প্রাদেশিক বলবে যে!

৪. ভাষায় আমায় ভুলাবি কত...

Novelistic realism, Anti-intellectualism, Orientalist… এখানেই থামি! এইসব শব্দগুলোর অর্থ যদি আপনিও না জানেন তাহলে চুপি চুপি জানিয়ে রাখি যে ওই সব বোদ্ধারা সিনেমা নিয়ে আলোচনা করার সময় এইসব শব্দের গোলাগুলি চালিয়ে লোককে ঘাবড়ে দিতে বিশেষ পছন্দ করেন। শব্দগুলোর মানে আমি জানি না, এদের জিজ্ঞেস করলে যে তিন পাতা লম্বা উত্তর আসে সে বোঝার ক্ষমতা ভগবান আমাকে দিতে ভুলে গেছেন।

৫. পড়াশুনো করে যে...

Source: Google Image (http://www.soundonsight.org/)
এরা যতটা সময় সিনেমা দেখে তার চেয়ে অনেক বেশী সময় ব্যয় করে উইকিপিডিয়া থেকে সেই সিনেমার মানে বুঝতে! সত্যি বলছি!! এমনকি কয়েকজনের ক্ষেত্রে তো আমার মনে হয়ে যে এরা সময়ের অভাবে সিনেমাটা না দেখে শুধু উইকিটা পড়ে নেয় যাতে ফেসবুকে আলোচনায় অংশ নিতে পারে। যেকোন আলোচনা বা তর্কতে পাত্তা না পেলেই এরা নানাবিধ বই-এর নাম বা সিনেমা সমালোচকদের নাম ছুঁড়তে শুরু করে যেগুলো আপনার জানার সম্ভাবনা খুবই কম! আর তার পরেই এদের ভাবখানা হয়, একটা সিনেমা দেখার পর যারা সেই সিনেমা নিয়ে গোটা কুড়ি বই পড়েনি তাদের সঙ্গে আর এরা কি আলোচনাই বা করবে!
এতে সমস্যা তেমন নেই। তবে ওগুলোর সঙ্গে সঙ্গে তারা যদি বেশ কিছু ভালো সাহিত্য পড়ত, বিশেষ করে কোন সিনেমা নিয়ে আলোচনার আগে সেটার মূল বইটা পড়ে নিত তাহলে যে একটু লাভ হত সেটা এদের ঘটে ঢোকানো বেশ শক্ত কাজ, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি!

৬. তুই আমার হিরো...

একটু আগে এদের অপছন্দের কথা বলেছি। এবার এদের পছন্দের কথা বলি। এদের সকলেরই এক বা একাধিক পছন্দের পরিচালক আছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে অভিনেতাও থাকতে পারেন। তা এদের কাছে এদের পছন্দের পরিচালক মোটামুটি ব্যাটম্যান, সুপারম্যান বা রজনীকান্তের ছোটখাট সংস্করণ! তাঁদের বানানো এক একটা সিনেমা যেন ছোট্ট একটা অ্যাটম বোম। প্রত্যেকটাই পৃথিবীর ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। আর শুধু সিনেমা নয়, তাদের প্রিয় পরিচালকের বানানো কলেজ প্রজেক্ট, শর্ট ফিল্ম, এমনকি দশ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনও তাদের কাছে বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের একেকটা হীরকখণ্ড এবং সেগুলোর প্রত্যেকটা দৃশ্যের মূল বক্তব্য তারা যেরকম বুঝেছে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় বোধ হয় যিনি পরিচালক তিনি নিজেও অত ভালো করে বুঝতে পারেননি!
এই প্রসঙ্গে, সিনেমা বোদ্ধা হতে চাওয়া পাঠকদের একটা ছোট্ট টিপস্‌ দিয়ে রাখি, যদি বাঙ্গালী পরিচালক পছন্দ করতে চান তাহলে সব সময় ঋত্বিকের ভক্ত হন এবং সত্যজিতের নিন্দে করুন। ওইসব গ্রুপে আপনার শত্তুর তো অনেক কমে যাবেই তার সঙ্গে আমি ঋত্বিককে বুঝি আর কেউ বোঝে না, এটা ভেবে যথেষ্ট শ্লাঘা বোধ করারও সুযোগ পাবেন!

আজকে আপাতত এখানেই শেষ করা যাক। সিনেমা দেখি বরং একটা। একটা সহজ সরল সিনেমা যেটা বোঝার জন্য আমাকে গুগল্‌ বা উইকিপিডিয়ার সাহায্য নিতে হবে না!

নিচের ফ্লো-চার্টটা বেশ পছন্দ হল, সেটাও দিলাম... 
Source: http://squathole.files.wordpress.com/2013/01/how-to-be-a-clever-film-critic.gif

Sunday, September 29, 2013

কিছু কথা বলার জন্য...

ডিসেম্বর মাসটা সবসময়ই স্পেশাল। স্যার জাদেজার জন্মদিন তো বটেই, মা-র জন্মদিন, আমার নিজের জন্মদিন, আমার প্রথম চাকরি পাওয়া, শ্রেয়ার সঙ্গে প্রথম দেখা, সব মিলিয়ে ডিসেম্বর মাস মানেই হৃদয়ের খুব কাছের অনেকগুলো ঘটনা। আর তার সঙ্গেই ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসকে মনে রাখার আরো একটা কারণ হল ‘কথা তো বলার জন্যেই’ তে প্রকাশিত আমার প্রথম লেখা।


২০১১ সালের ১লা ডিসেম্বর ‘কথা তো...’ ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় আমার লেখা গল্প ‘সেই লোকটা’। আমার জীবনের অন্যতম সেরা আর মনে রাখার মত দিন সেটা।
ছোটবেলা থেকে লিখতে ভালোবাসি। দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখেছি আমার লেখা ছাপা হচ্ছে শুকতারা, আনন্দমেলা বা দেশ পত্রিকায়। সেই স্কুলে পড়তেই নিজের অপটু, কাঁচা হাতের লেখা গল্প, উপন্যাস, কবিতা বন্ধুদের পড়িয়ে তাদের হাসি-ঠাট্টা, পেছনে লাগার পাত্র হয়েছি অনেকবার। শেষপর্যন্ত নিজে ব্লগ লেখা শুরু করেছি ২০০৮ সালে।
কিন্তু ‘সেই লোকটা’ আমার প্রথম গল্প যেটা আমার নিজের ব্লগের বাইরের অন্য এক সাইটের মাধ্যমে অন্তর্জালের এই বিশাল জগতে জায়গা পেয়েছিলআমার প্রথম লেখা যেটা আমার নিজের বন্ধু-বান্ধবের গণ্ডী পেরিয়ে পৌঁছে গেছিল আমার অচেনা পাঠকদের কাছে।

এখনও মনে আছে, প্রথম লেখা পাঠানোর আগে সুনন্দকে আমি চিনতাম না। ফেসবুকে কোন এক বন্ধুর দেওয়ালে ‘কথা তো বলার জন্যেই’-র নানা রকমের লেখা দেখে আমি ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ‘সেই লোকটা’ সুনন্দকে মেল করি। সেই সময় আমি বাংলাওয়ার্ড ব্যবহার করে লিখতাম। প্রায় কুড়ি দিন পর সুনন্দ জানায় যে, গল্পটা তার পছন্দ হলেও অভ্রয়ে লেখা না পাঠালে তা প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুনন্দর কথা মত গল্পটা আবার অভ্রতে টাইপ করে পাঠাই আমি, আর তার পরেই প্রকাশিত হয় ‘সেই লোকটা’ ‘কথা তো...’-র সাইটে।
সেই শুরু, তারপর থেকে সুনন্দ প্রকাশ করেছে আমার অনেকগুলো লেখা। কিছুদিন লেখা না পাঠালেই এসে তাগিদা দিয়ে গেছে নতুন লেখার জন্য। এমনকি আমার ব্লগের পোস্ট পড়ে সেই লেখা ওকে না দিয়ে নিজের ব্লগে বের করে দিয়েছি কেন সেই নিয়ে ছদ্ম কলহ করেছে আমার সঙ্গে।
আমি একের পর এক পাঠিয়ে গেছি ‘মাংস’, ‘বর্ণময় পর্নো’, ‘বৃষ্টিমঙ্গল’ মত নানা ধরণের লেখা। সেগুলো বেড়িয়েছে ‘কথা তো...’-র সাইটে। অচেনা-অজানা জনগণের সঙ্গে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে লেখার গুণাগুণ নিয়ে।
সুনন্দ আর সংহিতার সঙ্গেও কথা হয়েছে লেখা নিয়ে, ওদের মতামত, প্রশ্নোত্তরের মধ্যে দিয়ে লেখার মান উন্নতি করার চেষ্টা চলেছে, এখনও চলছে।

এই সপ্তাহে ‘কথা তো বলার জন্যেই’-র সাইটে প্রকাশিত হয়েছে আমার নতুন লেখা ‘প্যাঁচাকাহিনী’। এই পত্রিকায় প্রকাশিত এটা আমার দশম লেখা!! আমার কাছে এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার! যখন প্রথমবার লেখা পাঠিয়েছিলাম তখন দশটা তো দূরের কথা, আমার আর একটা লেখাও আর কোথাও কোনদিন প্রকাশিত হবে বলে ভাবিনি। কিন্তু পৃথিবীর আরো হাজারটা অত্যাশ্চর্য্য ঘটনাগুলোর মত এই জিনিসটাও ঘটেছে। আমার ব্লগ ছাড়া আরো একটা ঘর তৈরী হয়েছে আমার লেখাগুলোর।
আমি এখনও স্বপ্ন দেখি নানা ধরণের পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে আমার লেখা। হয়তো একদিন বইমেলার আসরে আরো ১০০-২০০ বইয়ের সঙ্গে বেরোচ্ছে আমার লেখা গল্পের বই। জানি না সে স্বপ্ন আদৌ কোনদিন বাস্তবায়িত হবে কিনা, কিন্তু আমি জানি ‘কথা তো...’ আমার পাশে আছে সব সময়, আমার কোন রকম দরকারে-অদরকারে ‘কথা তো...’-র পরিবার এগিয়ে আসবে সব সময়, আবার হয়তো ওদের দরকারের সময় বন্ধুর মত হাত বাড়িয়ে দেব আমি।

তবু একবার, হয়তো কিছুটা অকারণেই, আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ‘কথা তো বলার জন্যেই’-কে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আরো বেশি, বেশি পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাও তোমরা। অবশ্য তাতে আমার লাভের ভাগটাও কম নয়, ‘কথা তো...’ নতুন পাঠকরা কি আর আমার দু-একটা লেখায় ক্লিক করে দেখবেন না!

আর সুনন্দ, নতুন লেখা মাথায় ঘুরছে, আর কদিনের মধ্যেই হয়তো এগারো নম্বরটাও পেয়ে যাবে।

Saturday, September 14, 2013

গল্প বলার গল্প

এই গল্পটা আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের। আমার বয়স তখন কত হবে, চারের আশেপাশে। কিছুদিন আগেই শিশুনিকেতন বলে একটা ছোট্ট ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি।
তখন থেকেই বই পড়ার নেশা। বাবা দেব সাহিত্য কুটীর থেকে ছবিতে রামায়ণ-মহাভারত কিনে দিয়েছে। সঙ্গে টুনটুনির বই, আবোল তাবোল আর ঠাকুমার ঝুলি। সেইসব বইগুলো যতবার পারি পড়ি আর কল্পনার ডানায় চড়ে উড়ে বেড়াই মজন্তালি সরকার, বোকা জোলা, কাঠ বুড়ো, বকচ্ছপ আর হেড অফিসের বড়বাবুর দুনিয়ায়।
ততদিন অবধি মোটামুটি মা-ই ঘুরে ঘুরে খাইয়ে দেয়। মানে, আমি সারা বাড়ি নেচে বেড়াই আর মা পেছন পেছন খাবারের থালা নিয়ে ঘুরে ভুজুং-ভাজাং দিয়ে, কাক-কোকিল দেখিয়ে খাওয়ায়। অথবা, আমি হয়তো টুনটুনির বই থেকে সেই নাক-কাটা রাজার গপ্পটা পড়ছি আর মা খাইয়ে দিল।
কিন্তু সুখের দিন গেল। মা একদিন বলল, “এবার বড় হয়েছিস। এবার থেকে আমি ভাত মেখে গোল্লা পাকিয়ে দেব। তুই নিজে নিজে খাবি।”
শুনেই মনটা কেমন খিঁচড়ে গেল। নিজে নিজে খেতে হবে, বড় হয়েছি বলে এ কী জুলুম! আমি তো জানি, বড় হলে শুধু বাবার মত রোজ অফিস যাব আর সন্ধ্যেবেলা ফিরে মন দিয়ে টিভিতে খবর দেখব আর ‘তেরো পার্বণ’ বলে কি একটা হয় সেটা দেখব মন দিয়ে।
তার মধ্যে মা আবার জানিয়ে দিল যে, গল্পের বই পড়তে পড়তে খাওয়া যাবে না। মন দিয়ে না খেলে নাকি খাবার হজম হবে না। এ তো বড্ড ঝামেলা! পুরদস্তুর বাওয়াল দিলাম, ঘ্যান ঘ্যান করা, নাকি কান্না ইত্যাদি প্রভৃতি।
যাই হোক শেষ অবধি একটা শান্তি-চুক্তিতে আসা গেল। ঠিক হল, আমি নিজে নিজেই খাবো কিন্তু মা-ও তখন খেতে বসে আমাকে গল্প বলে শোনাবে। তাতেই আমি রাজী।
তা মা গল্পও বলে নানা রকমের। বেশিরভাগই রূপকথা, তাছাড়া এদিক-ওদিক, ঐ বেড়ালের খাবার খেয়ে যাওয়ার গল্প, বারান্দার কাকের গল্প এইসব আর কি।
তা সেইসব গল্পের স্টকও একদিন শেষ হয়ে এল। তারপর মা যে গল্পই বলে আমি ব্যাগড়া দি, “এটা তো আগে বলেছ”, “ওইটা তো পরশু দিন বললে, ছোট রানীটা দুষ্টু...”
হতাশ হয়ে মা শেষ অবধি গল্প ফাঁদল,

-   বুঝলি তো, তিনটে বন্ধু ছিল। গ, ল আর প।
-   গ, ল, প... বাঃ বাঃ... কি রকম বন্ধু? আমার ইস্কুলের মলয় আর কৌশিকের মত?
-   হ্যাঁ রে... সেই রকম খুব বন্ধু।
-   আচ্ছা... তাপ্পর?
-   একদিন গ, ল, প একসঙ্গে যাচ্ছিল...
-   কোথায় যাচ্ছিল?
-   কোথায় যাচ্ছিল... উঁ... ঐ যে... হ্যাঁ, সার্কাস দেখতে।
-   ওমা... সার্কাস? কি মজা? সার্কাসে হাতি ছিল?
-   হাতি তো থাকবেই রে বোকা, তারপর শোন না... আচ্ছা এই গোল্লাটা খেয়ে নে।
-   খাচ্ছি... তুমি বল
-   হ্যাঁ... তো ওরা তিনজন যাচ্ছে যাচ্ছে... এমন সময় সামনে একটা বিরাট বড়ো নদী পড়ল...
-   কি নদী? কত বড়ো?
-   হুগলী নদী... সে বিশাল বড়ো।
-   নদীতে মাছ ছিলো?
-   নদীতে মাছ থাকবে না? অনেক মাছ ছিল... ইলিশ, রুই, কাতলা...
-   তাপ্পর?
-   তখন তারা দেখল কি... গ আর প সাঁতার জানে কিন্তু ল একদম সাঁতার জানে না...
-   আমার মত?
-   হ্যাঁ...
-   তাহলে কি হবে? ল ডুবে যাবে?
-   দুর বোকা... ল-এর বন্ধু গ আর প ছিল তো... আর প-এর গায়ে জানিস তো খুব জোর...
-   খুব জোর? রামায়ণের হনুমানের মত?
-   ঠিক বলেছিস!
-   তাপ্পর কি হল?
-   তখন প বলল, আমি ল-কে আমার কাঁধে করে নিয়ে নদী পার হব!
-   ওমা... তাই?
-   হ্যাঁ তো। তখন নদীতে পাশাপাশি নামল গ, আর প-এর কাঁধে ল... হয়ে গেল গল্প! এবার এই চারটে গোল্লা বাকি আছে, খেয়ে নে...

কত কত নোবেলজয়ী, বুকারজয়ী লেখকের বই তো পড়ে ফেললাম কিন্তু ছোটবেলার এই গল্পের মত সহজ-সরল, মনে থেকে যাওয়া গল্প খুব বেশি পেলাম না!
"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”